১। জুতার নিচে শুকনো পাতারা মচমচ করে ভাঙছে। শব্দটা মন দিয়ে অনুভব করার চেষ্টা করে চৈতি, এতো ভালো লাগে কেন এই শব্দটা! বোরকার ভেতরে দরদর করে ঘামছে ও, বিকেল হলেও রোদের তেজ এখনো কমেনি। আওয়াল ওয়াক্তে আস্রের সলাহ পরে বেরিয়েছে তিন বোন, বড় বড় গাছের রাজ্যে হারিয়ে যেতে মানা নেই এখন। ডিএসলারের লেন্স ক্যাপটা খুলে ফোকাসিং এর চেষ্টা করছে অনীমা। মাত্রই উপহারটা আদায় করেছে বাবা-মা’র থেকে। এসএসসি পরীক্ষা শেষ হয়েছে এক সপ্তাহ আগে। বাবা আবরারের দাবি ছিল সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে, ফলাফল ব্যাপার না। অনীমার দাবি ছিল ব্যক্তিগত ডিজিটাল ক্যামেরা, দাবি পূরণ হয়েছে। অনীমা শেষ সময়টা খুব খেটেছে।
নিয়মিত যদি আগে পড়তো তাহলে হয়তো এতো খাটতে হতো না। মা সিমি ভীষণ চিন্তায় ছিল, প্রেশার আপডাউন করেছে পুরো দুই মাস। আবরারের মতে,”এসএসসি পরীক্ষাটা তুমিই দিচ্ছো!” টিটকারিতে রেগে আগুন হতো অনীমার মা। ঢাকার বাইরে আবাসিক স্কুলে পড়ে বলেই পড়ালেখায় এতো ফাকি দিতে পেরেছে, মায়ের চোখের সামনে থাকলে এই সুযোগ পেতো না – এটাই সিমির বদ্ধমূল ধারণা। ভাশুরের দুই মেয়ে চৈতি-নীতিকে চোখের সামনে পেয়েছে সিমি, ঠিকমতো পড়ছে কিনা মেয়ে দুটো সবসময় খেয়াল রেখেছে সে। ওদের মা তো থেকেও নেই, তাই অনীমা ঢাকায় না থাকলেও দায়িত্ব কম ছিল না সিমির। দুই বোনের রেজাল্টে সিমির মনে হয়েছে নিজের পরীক্ষার রেজাল্টই যেন পেল।
জেএসসিতে ট্যালেন্টপুলে বোর্ড স্কলারশিপ পেয়েছে চৈতি আর নীতির জিপিএ ফাইভ মিস হয়নি। নীতিকে নিয়ে চিন্তায় ছিল সিমি। একে তো মা কাছে থাকেনা দেখে সবসময় একটা দুঃখের মধ্যে থাকে মেয়েটা, তার উপর হিফ্যের পড়ার চাপের পাশাপাশি বাংলা মিডিয়ামের পড়া। ভাশুর ওয়াসিমকে অনুরোধ করেছিল সিমি, হিফ্যটা অন্তত পিএসসির সময় বন্ধ রাখুক। ছোট মাথায় এতো চাপ কিভাবে নিবে মেয়েটা! ভাশুর রাজি হননি, একবার পড়ার গতি থেমে গেলে আবার হিফ্যে মন দেয়া কঠিন। পিএসসি পরীক্ষাকে কোনো গুরুত্বই দিলো না, সব চিন্তা যেন সিমির একার। হিফ্য করাই লাগবে এমনটা ভাবে না ওয়াসিম। কিন্তু নীতি খুব ভালোবেসে আল্লাহ্র বাণী মুখস্থ করছে এটাকে সবসময় উৎসাহিত করা উচিত। মস্তিষ্ক এমন একটা থলে যেটায় যত বেশি রাখা হবে তত বড় হবে। পড়াকে চাপ হিসেবে নিলেই সমস্যা। দুনিয়াবি পড়ার জন্যে কখনোই ওয়াসিম-শেফা সন্তানদের নিয়ে দুশ্চিন্তা করেনি। ওয়াসিম বরাবর এক কথা বলে, “জানার জন্যে পড়ো, ভালো ফলাফলের ইদুর-দৌড়ে যেয়ো না। তোমার জ্ঞান শুদ্ধ হলে রেজাল্ট এমনি ভালো হবে যদি না ভাগ্যে ভিন্ন কিছু লেখা থাকে।“
নীতি যেন উড়ে বেড়াচ্ছে মানুষহীন জংগলে, ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ শহরে ওর মতো পর্দানশীন মেয়ের দৌড়ানোর সুযোগ কোথায়! গাজীপুরের কাপাশিয়ায় এক বাংলোতে উঠেছে ওরা। চাচা আবরারের প্রবাসী বন্ধুর পড়ে থাকা বাড়ি, দুই-তিনজন দেখাশোনার মানুষ ছাড়া আর কেউ নেই। অনীমার এসএসসি পরীক্ষা শেষ হতেই আবরার বললো, “তোদের তো শিকড় গজিয়ে যাচ্ছেরে,অনেকদি
অর্ধেকের বেশি জিনিস নামিয়ে রেখেছে চৈতি। বমির ওষুধ খেয়ে গাড়িতে উঠার পরও সারা রাস্তা গা গোলাচ্ছিল চৈতির। মোশন সিকনেস আছে ওর। নীতি বরাবরের মতো রাস্তার দোকানের ব্যানারগুলোর বানান ভুল দেখতে দেখতে গেছে আর অনীমা ফেইসবুক হোমপেইজ স্ক্রল করে আড়াই ঘন্টা পার করেছে। আবরার ড্রাইভিং করেছে অতি সতর্কতায়, তিন কলিজার টুকরোকে নিয়ে দূরের পথ পাড়ি দিচ্ছে।
বাংলোতে এসে পৌছেছে ওরা সকাল দশটার পর। দাড়োয়ানের স্ত্রী এই কয়দিনের জন্যে ওদের রান্নাবান্নার দায়িত্বে আছে। তার তৈরি করা নাস্তা খেয়ে ওরা একটু বিশ্রাম নিয়েছে। দুপুরে মাছের ঝোল, ডাল, ডিম ভুনা দিয়ে ভাত খেয়ে অল্প কিছুক্ষণ বিছানায় গড়িয়ে নিল। তারপর আবরারের অনুমতি নিয়ে বেরিয়েছে ওরা। বেশিদূর যাবার অনুমতি নেই। বাংলোর পাশেই মেহগনি, ইউক্যালিপ্টাসের
“বেশি দূর যাস না নীতি!” একটা কাঠবিড়ালীকে ফোকাস করতে করতে বলে অনীমা। ক্যামেরার ব্যবহারটা তার জ্যাঠামণির থেকেই শেখা। জ্যাঠার একসময় ফটোগ্রাফির নেশা ছিল। তার অনেক কিছুই অনীমার ভালো লাগে। মিলিটারি স্কুলে পড়েছে জ্যাঠার মতো বড় আর্মি অফিসার হওয়ার ইচ্ছাতেই। মায়ের কারণে হয়তো কলেজটা ঢাকাতেই পড়তে হবে। সেক্ষেত্রেও অনীমার ইচ্ছা সেনাবাহিনী পরিচালিত কোনো কলেজে পড়ার। জ্যাঠা আর চৈতি এখন ভিন্ন সুরে গায়,কেউ চায় না অনীমা ডিফেন্সে ক্যারিয়ার করুক। কিন্তু অনীমার জীবনের আদর্শ আগের সেই জ্যাঠামণি আর বাবা-মা সবসময়ই অনীমার স্বপ্নগুলোকে সমর্থন দিয়ে এসেছে।
“তোমরা আমাকে এতো চোখে চোখে রাখো কেন বলোতো? আমি কি বাচ্চা? আমি এখন হাইস্কুলে পড়ি জানো তো?” নীতি বিরক্ত হয়ে অনীমাকে বলে।
অনীমা আর চৈতি চোখাচোখি করে। সিক্সে ওঠার পর থেকে নীতি নিজেকে বড় মনে করছে অনেক। চৈতি ইতোমধ্যে গাছের ছায়ায় বসে পড়েছে। নিকাব পড়ায় বোঝা যাচ্ছে না ঠোট জোড়া যিক্রে ব্যস্ত। নিকাবের অন্যতম বড় সুবিধা এটাই, যিক্র লুকানো যায় মানুষ থেকে। গাছের ফাঁকে ফাঁকে পাওয়া আকাশে সন্ধ্যার আগে শেষ চক্কর দেয়া পাখিদের মেলা। চৈতি আর অনীমার মগ্নতার মাঝে কখন যে নীতি চোখের আড়াল খেয়াল হয়নি দুই বোনের। হঠাৎ একটা চিৎকারে দুইজনের হুশ ফিরে। নীতি নেই, লাফ দিয়ে শব্দের দিকে দৌড়ায় ওরা। কারো নামগন্ধও নেই। এতো ঘন জংগলও নয় যে কেউ হারিয়ে যাবে মুহুর্তের মধ্যে। নিজেদের দৌড়ের সাথে অন্যের দ্রুত সরে যাওয়ার আওয়াজও পেয়েছে চৈতি। কিন্তু কাউকেই দেখেনি, সামনে একটি ছোট্ট কুড়োঘর তারপর আবার পায়ে হাটা রাস্তা। মাটির তৈরি কুড়েঘরে খড়ের ছাউনি। কাঠের দরজায় আঘাত করে অনীমা। খোলার কেউ নেই দেখে আবার বাড়ি দিতে ধরে, চৈতি আটকায়, “অনি, তালা দেয়া রে। ভেতরে কেউ নেই।“ গলা দিয়ে যেন স্বর বেরোচ্ছে না চৈতির। অনীমা হাল ছাড়ে না, “এদিক থেকেই এসেছে শব্দটা।“ শিক দেয়া জানালা দিয়ে উঁকি দেয়। একটা ট্রাংক পেতে টেবিলের মতো করা হয়েছে, পাশে একটা চেয়ার। পুরো ঘরটাই খালি। এখানে কেউ হয়তো আসে। কিন্তু এখন কেউই নেই।
দুশ্চিন্তায় অনীমার মুখ লাল হয়ে গেছে। কুড়েঘরের পিছনের পায়ে চলা পথটায় দৌড়ে চলে দুই বোন। একসময় বুঝতে পারে পথটা শেষ হয়ে গেছে, শেষ হয়েছে তাদেরই বাংলোর পেছন গেইটে!
২
চোখের পানি থামাতে পারছে না চৈতি। ফোনটা এসেছে সকাল ৮টায়, বাংলোর ল্যান্ডফোনে। নীতিকে অপহরণ করা হয়েছে। তিনদিনের মধ্যে পঞ্চাশ লাখ টাকা মুক্তিপণ না পেলে দেশের বাইরে পাচার করে দিবে। উড়ো ফোনটা রিসিভ করেছিল আবরার, মোটা কন্ঠের একজন পুরুষ কথা বলেছে। বয়স চল্লিশের বেশি হবে বলে তার ধারণা। সারারাত ঘুমায়নি অনীমা আর চৈতি। মাথায় হাত দিয়ে বসেছিল আবরার। আবরার একবারও বকেনি ওদের, শোকস্তব্ধ হয়ে গেছে যেন।
কাঁদতে কাঁদতে চোখে ফুলে গেছে দুই বোনের। নিজের উপর রাগ হচ্ছে তবু রাসূলুল্লাহ্র নির্দেশ অনুযায়ী “ক্বদরুল্লাহি ওয়ামা শাআ ফা’আলা” ( আল্লাহ্র নির্ধারণ, আল্লাহ যা চেয়েছেন তাই হয়েছে) দুআটা পড়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করেছে চৈতি। আফসোস করলে শয়তানের দরজা খুলে যায়, “ইশ যদি একটু নীতিকে চোখে চোখে রাখতাম” এমন চিন্তা বাদ দিয়ে ক্রমাগত বিপদের দুআ পড়ে যাচ্ছে ও। “ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রজিঊন, আল্লাহুম্মা যুরনী ফী মুসীবাতি ওয়া আখলিফ লী খইরম মিন্হা।“ (নিশ্চয় আমরা আল্লাহর জন্য এবং নিশ্চয় তাঁর কাছেই আমরা ফিরে যাব। হে আল্লাহ আপনি আমাকে এই বিপদের পুরস্কার দিন এবং আমাকে এর পরিবর্তে এর চেয়ে উত্তম কিছু দিন)। রাত তিনটার দিকে ওযু করে সলাতে দাঁড়িয়েছিল চৈতি। পাশে কখন আরেকজন এসে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করেনি, সিজদাহতে ফুপিয়ে কান্নার দমক শুনে চৈতি বুঝেছে অনীমাও আছে সাথে। কান্না কখনো সংক্রামক ছিল না চৈতির জন্যে, কিন্তু আজ থামাতে পারছে না। রাতে খাবার নামেনি গলা দিয়ে। আবরার ওদেরকে জোর করে অল্প কিছু মুখে দিতে বাধ্য করেছে। মা বাবার কাছে খবর গেছে আজ সকালে। সারারাত আবরার নিজের মতো খোঁজার চেষ্টা করেছে। জিডি করেনি আগেই। সকালের ফোনের পর মনে হচ্ছে না করাই ভালো হয়েছে এতে নীতির আরো ক্ষতি হতে পারে।
৯টার আগেই জিপটা এসে থামলো। ওয়াসিম নামলো গাড়ি থেকে। তারপর সবাইকে চমকে দিয়ে বের হলো শেফা, চৈতি-নীতির মা। চৈতির নীতির জন্যে আরো বেশি খারাপ লাগা ছেয়ে গেল, এই দৃশ্য নীতির মনে কতটা আনন্দ দিতে পারতো! নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না অনীমা, “আজ কেন! আজ কেন তোমরা একসাথে আসলে! নীতিটা যতদিন চেয়েছে ততদিন এক হতে পারলে না!”
জেঠিমণিকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে দিল অনীমা। ওয়াসিম যথেষ্ট শক্ত থাকার চেষ্টা করলেও ফোলা চোখ বলে দিচ্ছে তার অবস্থা। আবরার সব জানালো। ওয়াসিম চুপচাপ শুনল, একবার শুধু গতকাল সন্ধ্যায় কেন জানায়নি তার জবাবদিহিতা চাইলো। খবর পাওয়ার পর এক মূহুর্ত দেরি না করে ছুটি নিয়ে শশুড়বাড়ি রওনা দিয়েছিল ওয়াসিম। জানেনা শেফা কোনোদিন অপেক্ষা করেছে কিনা ওয়াসিমের, কিন্তু ওয়াসিম প্রতি মূহুর্তে শেফার ফেরার অপেক্ষায় দুআ করেছে; “হে আমাদের রব! আমাদের নিজেদের জীবনসংগীদের ও সন্তানদেরকে আমাদের জন্যে চক্ষু শীতলকারী করো এবং আমাদেরকে করে দাও মুত্তাকীদের ইমাম।“ (সূরা ফুরকানঃ৭৪)। এমন একটা বিপদে শেফাকে নিয়ে যেতে হবে কখনো ভাবেনি ওয়াসিম। নীতির নানা নানুকে বুঝতে না দেয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়েছে ওরা। কিন্তু বয়স্করা তাদের অভিজ্ঞতা দিয়ে বিপদের গন্ধ ঠিকই আঁচ করেছে। বের হওয়ার সময় শেফা যখন কাফতানের সাথে খিমার চাপিয়ে বের হলো ওয়াসিম একই সাথে অবাক আর খুশি হয়েছে। তিন-চার বছর আগে ওয়াসিম আর শেফার দূরত্ব তৈরি হয়েছিল দ্বীনের জন্যেই।
ওয়াসিম চাইতো তার স্ত্রীও তার মতো জীবনটা পালটে ইসলামের দিকে ঝুঁকবে। কিন্তু তার হঠাৎ পরিবর্তন মেনে নিতে পারেনি শেফা। প্রচন্ড মানসিক চাপ লাগতো তার কাছে। একটা সংস্কৃতি-জীবনবো
ঢিলেঢালা বোরকার সাথে খিমার পরা শুরু করেছে বড় মেয়ে চৈতির পরামর্শেই। নীতির খবরটা শুনে সামান্য দ্বিধা না করে ওয়াসিমের সাথে রওনা দিয়েছেন। ওয়াসিম একদমই পরিবারের কারো বিপদে ধৈর্য রাখতে পারে না। যে দাড়ি রাখায় ওয়াসিমের চেহারাটা অচেনা হয়ে গিয়েছিল সেই দাঁড়িতেই আজ অসাধারণ ঠেকছে শেফার কাছে, ইসলামের প্রতি ভালোবাসা তার দৃষ্টিভংগি পাল্টে দিয়েছে। মেয়ের জন্যে দুশ্চিন্তা তারও হচ্ছে। কিন্তু মনের ভেতর কোথাও দৃঢ় বিশ্বাস আছে, আল্লাহকে ডেকে কখনো ব্যর্থ হয়নি সে। এবারও আল্লাহ সাহায্য করবেন- মজবুত বিশ্বাস তার।
চৈতি অনীমার কাছে আবার খুঁটিয়ে সব শুনলো ওয়াসিম। সবাই বের হলো, নীতিকে যেখানে হারিয়েছিল ঠিক সেই জায়গায়। কুঁড়ে ঘরটার কাছে এসে থামলো। তালা দেয়া কুড়েঘরে। তালাটা বেশি পুরানো মনে হয়না। আবরার খোঁজ নিয়েছে দাঁড়োয়ান থেকে, কুড়েঘরটাও বাংলো মালিকেরই। পড়ে আছে এমনি, কেউ যায় না ওদিকে। ওয়াসিম তালা ভেঙ্গে ঘরে ঢুকবে কিনা ভাবতে না ভাবতেই চৈতি কাধে ঝোলানো ব্যাগ থেকে মিশন বক্সটা বের করলো।
“টিম প্রত্যুৎপন্নমতি
“এমন কেইস আমাদের জীবনে আর না আসুক চাচ্চু!”
কথা না বাড়িয়ে কয়েকটা স্ক্রু ডাইভার আর পিন দিল চৈতি, কয়েকবারের চেষ্টায় খুলে গেল তালা। মাটির ঘরটা সূক্ষভাবে পর্যবেক্ষণ করলো ওরা। ট্রাংকের উপর চাদর দিয়ে টেবিল বানানো হয়েছে। চাদর সরিয়ে ট্রাংক খুললো ওয়াসিম, কয়েকটা কাঁথা কাপড়, তার নিচে কাঠের পাটাতন। কোনো কিছু না পেয়ে কুড়েঘর আবার আগের মতো তালা দিয়ে পেছনের পায়ে চলা পথের দিকে আগালো ওরা। কোথাও থেকে ভেসে আসা কিশোরীর চিৎকারে থমকে গেলো ওরা। চিৎকারটা খুব ক্ষীণ,বুঝলো না ওরা শব্দের উৎস কোথায়। ওয়াসিমের চেহারা দেখে মনে হলো ভেংগে পড়বে যেকোনো মুহূর্তে। পায়ে চলা পথে বাংলোর পেছনের গেইটে এসে পৌছাল সবাই। বাংলোর সীমানার মধ্যে পরিচ্ছন্ন সাজানো ফুল-ফলের বাগান। বিশাল বাংলোর প্রতিটা ঘর চেক করতে চায় ওয়াসিম। আবরার জানালো যেদিন নীতি হারিয়েছে সেদিনই দাড়োয়ানকে সাথে নিয়ে প্রতিটা ঘর ঘুরেছে ও। আরো মুষড়ে গেলো সবাই।
দুপুরে চিংড়ির দোপেয়াজা, দেশী মুরগীর ঝোল, চিচিংগা ভাজি,ডাল আর বাসমতি চালের ভাত। আবরার আগেই বলে রেখেছিল তার ভাই আসবে তাই দাড়োয়ানের স্ত্রী রান্না করে রেখেছে। জোর করে খাচ্ছে যেন সবাই, খাওয়া শেষে অনীমা আর চৈতি দাঁড়োয়ানের স্ত্রীকে ডাকলো। ওয়াসিম কতগুলো প্রশ্ন করতে চায়। আশেপাশে এমন বাচ্চা হারানোর ঘটনা আরো ঘটেছে জানালো সে, “বুঝলেন ভাইজান, মাইনষের টেকার লুভ তো কমে না। টেকার লুভেই মাইনষে ঐডি করে। আপনার সুনার সংসার, ফুলের লাহান মাইয়া; হের উপরেও বিষ নজর পড়লো। আমগোর পাশের ঘরের একটা মাইয়া,নীতি আন্টিরই বয়সী। তারেও পাওয়া যাইতেসে না এক হপ্তা হইলো। আরো কয়েকজনের হারাইসে ৯-১০ বছরের মাইয়া, গরীবের পোলাপান চোখে চোখে কেডায় রাখবো!”
ওয়াসিম পাশে রাখা পানির জগ থেকে অল্প একটু পানি নিয়ে মাথায় দেয়। মাথা দিয়ে গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে যেন। দাড়োয়ানের স্ত্রী উঠার আগে আফসোস করলো কেউ ঠিকঠাক খায়নি বলে, “ছোট ভাই দু আমারে কইলো বালো কইরা রাইন্দা রাখতে ভাই ভাবী আসবো, আফনেরা কেউ খাইলেনই না। রান্না ভালো লাগসে না ভাবীসাব?”
ওয়াসিমের এসব অতিরিক্ত কথা ভালো লাগছিল না। দাড়োয়ানের স্ত্রীকে দ্রুত বিদায় করে দাড়োয়ানকে ডাকা হলো। দাড়োয়ানের মুখ কালো হয়ে আছে। প্রথম দিনের হাসিখুশি আন্তরিক চেহারাটা বেশিই মলিন লাগছে চৈতির কাছে। খেয়াল করে দেখলো চৈতি গালে আচড়ের দাগ,শার্টের উপরের দিকের বোতাম খোলা, চকচকে শার্টটার একটা দিক ছেড়া।
“চাচা আপনার গালে কি হয়েছে?”
“আর কয়োনা মামণি,বিড়ালে আঁচড়াইছে। বেজাত বিড়াল”
“কোনার কুড়েঘরটায় কখনো যান আপনি?”
মুখ আরো শুকনো করে দাঁড়োয়ান বলে, “আম্মা এতো বড় বাড়ি পাহারা দিয়াই কুল পাইনা আর ঐ ঘরে যামু! তাও যাওন লাগে মাঝে মইদ্দে। ময়নার মারে দিয়া ঝাড়াই মুছাই।“
কোনো অস্বাভাবিক কিছু বা অপরিচিত কাউকে বাড়ির আশেপাশে দেখেনি জানালো দাড়োয়ান। চলে যাওয়ার আগে চৈতি ডাকে, “চাচা শার্ট কি নতুন কিনেছেন?”
একগাল হাসে দাড়োয়ান, “আইজকাই প্রথম পরলাম! তোমার চাচী জমানি টেকা দিয়া কিনা দিসে,ভালুবাসা দিবস না কি জানি কয়! আর কয়ো না মায়া! টিবি দেহে সারাদিন, মাইয়া লুকের আর কাম কী! এডি দেইখা কত রঙ-ঢং যে শিহে বেইট্টান।“
দারোয়ান চলে যায়। ওয়াসিম তাকায় চৈতির দিকে, “সন্দেহ করছিস?”
“দুইজনকেই লিস্টে রাখো বাবা। তুমি টিএন্ডটি ফোন কলের লিস্টটা বের করতে পারলে?”
“একজনকে দায়িত্ব দিয়ে রেখেছি। মেইল চলে আসার কথা।“
মেইল চেক করে অবাক হলো ওয়াসিম। লগে ৮টা থেকে ৯টায় কোনো ফোন নঃ নেই। আবরার,চৈতি সবাই কনফার্ম করলো সময় ওটাই ছিল।
৩
রাতের পরিষ্কার আকাশে তারা দেখার জন্যে বাংলোর আঙ্গিনায় চাদর বিছিয়েছিল আবরার, টেলিস্কোপ সেট করেছিল। সেটা দিয়ে চাঁদের কলংক দেখাবে সবাইকে আর রাতের আকাশের তারা। আবরারের জ্যোতির্বিজ্ঞান
অনীমা তারা খসা দেখতে পায়। উত্তেজিত হয়ে চৈতিকে দেখায়,” দুআ কর এখন নীতির জন্যে”
“এসবের কোনো বেইজ নেইরে অনি। আমরা শুধু আল্লাহ্রই ইবাদত করি। তারা খসার সাথে দুআ কবুলের কোনো সম্পর্ক নেই। ওসব সস্তা সিনেমা উপন্যাসের বিষয়।“
“ওহ! জানতাম না!”
চৈতির মুখ থেকে কথা বের করার চেষ্টা করে ওয়াসিম, “তুই দাড়োয়ানকে কেন সন্দেহ করছিস?”
চৈতি এড়িয়ে যায়।
“দেখিস, গোয়েন্দা-গোয়েন্
মানসিক চাপ অনুভব করলেও মুখ খোলে না চৈতি। বাংলোতে নিজেদের ঘরে ফিরে রাতের খাবারের জন্যে হাত মুখ ধুয়ে নেয় ওরা। জানালা দিয়ে বাইরে তাকায় অনীমা। গাঢ় অন্ধকারকে দূর করছে চাদের স্নিগ্ধ আলো। হঠাৎ কি একটা দেখে বিস্ময়ে চোয়াল ঝুলে পরে ওর,”চৈতি! জলদি আয়!”
চৈতি লাফ দিয়ে উঠে। অনীমা কী দেখাতে চায় বুঝে না ও। চৈতি আমতা আমতা করে। আস্তে ধীরে আবরারকে টেলিস্কোপ নিয়ে হেটে আসতে দেখা যায়।
“আমি মাত্র একটা ছায়াকে হেটে যেতে দেখলাম, নীতির মতো লাগলো। ফুল গাছগুলোর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো মনে হয়।“
“নীতি যথেষ্ট ভিতু মেয়ে অনি, ওর এতো সাহস নেই। আসলে সারাদিন ওকে নিয়ে ভেবে তোর হেলুসিনেশন হচ্ছে, দৃষ্টি বিভ্রম!”
অনীমা পুরোপুরি মানতে পারলো না। ডাইনিং এর দিকে গেল দুই বোন। মেয়েরা আগে খেয়ে নিবে তারপর দুই ভাই খাবে। শেফা আর আবরার পরস্পর গায়ের মাহ্রাম, এক টেবিলে খাবে না তাই। শেফা এখনো অত কিছু মেনে চলা শুরু করেনি আর আবরার তো মানেই না অনেক কিছু। কিন্তু ওয়াসিমের নির্দেশ মানতে কেউ দ্বিতীয়বার ভাবলো না। খেতে বসে ওয়াসিম আবরারকে বললো বন্ধুকে যেন ফোন দেয়, কুড়েঘরে কোনো রহস্য আছে বলেই ওর মনে হয়। আবরার ফোন দিয়ে না পেয়ে সকাল হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে বললো। সবাই দুশ্চিন্তা নিয়ে ঘুমাতে গেল। ঘুম আসবেনা ভাবলেও সারাদিনের ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে গেল সবাই।
সকালে নাস্তার টেবিলে আবারো তাগাদায় ফোন দিল আবরার। এবার বন্ধুকে পেল! চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেলো, ঐ ঘরের ট্রাংকটা আসলে একটা গোপন দরজা,যেটা মাটির নিচে চলে গেছে! কোনো কাঁথা বা তক্তা থাকার কথা না, এন্ট্রান্স সবসময় খোলাই রাখতো সে। ক্ষীণ চিৎকারের উৎস বুঝতে অসুবিধা হলো না কারো। দ্রুত পুলিশ ফোর্সকে খবর দিল ওয়াসিম। দাড়োয়ান আর স্ত্রীও জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে বন্দি, কুড়েঘর ঘিরে আছে পুলিশ। ট্রাঙ্ক খুলে নিচে নামলো ওয়াসিমসহ পুলিশরা। কাঠের পাটাতনের নিচে ঢাকা পড়েছিল সিঁড়ি। নিচের ঘরটা সুন্দর গোছানো, বুকশেল্ফ ভর্তি বই। কিন্তু তার মাঝে বন্দী কয়েকজন কিশোরী। নিচ থেকে বের করে আনা হলো ৫ জন কিশোরীকে! কিন্তু তাদের একজনও নীতি না!
৪
অজানা আশংকায় কেঁপে উঠেছে ওয়াসিমের মন। প্রতিটা হারানো মেয়ের পরিবার জিডি করেছিল। যার যার সন্তান ফিরে গেছে মায়ের কাছে, শুধু নীতিকেই পাওয়া যাচ্ছে না। দাঁড়োয়ান আর তার স্ত্রীকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। অপহৃতরা চিহ্নিত করেছে ওদের আসামী হিসেবে। পুরো চক্রকে ধরার চেষ্টা চলছে। দেশের বাইরে কিশোরীদের পাচার করতো ওরা।
দাড়োয়ানের পাশের বাড়ির মেয়েটাকেও পাওয়া গেছে।
“কইসিলাম না আমারে আটকায়া রাখা যাইবো না। আমার নখের যেই ধার, গাল জ্বইলা যাওনের কথা!” দাড়োয়ানের গালের দিকে দেখায় মেয়েটা!
ড্রয়িং রুমে বিধ্বস্ত অবস্থায় বসে আছে সবাই। চৈতিকে চিন্তামুক্ত মনে হচ্ছে যেন হঠাৎ। দাঁড়োয়ানকে সন্দেহ করার কারণ ছিল কুড়েঘরের পাশের ঝোপে তার শার্টের একটা অংশ আটকে গিয়েছিল। সেটা চৈতি উদ্ধার করেছে। পুলিশকে বুঝিয়ে দিয়েছেও সূত্রটা। ঐ কুড়েঘরে মাঝে মাঝে যায় বললেও সেদিন যাওয়ার কথা প্রকাশই করেনি লোকটা। দাড়োয়ানকে গ্রেফ্তার করে নিয়ে যাওয়ার আগে চৈতি অদ্ভুত একটা প্রশ্ন করে, “যেদিন নীতি হারায় আপনি কোন কোন বদ্ধ ঘর খুলে দেখিয়েছেন চাচ্চুকে?” প্রচন্ড অবাক একটা দৃষ্টি দেয় সে, “কোনো ঘর তো দেখাইসি না মায়া। জুয়ার চক্করে পইড়া খারাপ বেডাগোর সাথে এই কাজে জড়াইছি। নীতি মামণির কতা জানিনা,কসম কাইট্টা কইতাছি তোমারে!”
“চাচ্চু, টিম প্রত্যুৎপন্নমতি
মুচকি হেসে ল্যান্ডফোনে ডায়াল করলো আবরার। ফোন পেয়ে নীতি বেরিয়ে আসলো।
“চাচ্চু তুমি বাবা-মাকে মিলিয়ে দেয়ার জন্যে এই প্ল্যান করেছিলে তাইনা?”
“ঠিক তাই! কিন্তু টিম প্রত্যুৎপন্নমতি
“আলহামদু লিল্লাহ! সকল প্রসংশা আল্লাহ্র! নীতিকে পেয়েছি, কয়েকজন মা-বাবার কোলে হারানো সন্তান ফিরেছে, বাবা-মা একসাথে আবার! দুনিয়ায় এরচেয়ে বেশি আমরা কিছু তো চাইনি!”
কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই আবরারের গালে ভারি হাতের চড় পড়লো, ওয়াসিম নিজের মেজাজকে ধরে রাখতে পারেনি।
“তোর জন্যে এতো মানসিক চাপের মধ্যে দিয়ে গেলাম আমরা!”
“ কয়েকদিনের মানসিক চাপ আর কয়েক বছরের মানসিক চাপ কি এক পাল্লায় মাপা যায়? মারলে আরো মারতে পারো। আমার ভাতিজিদের জন্যে, পুরো পরিবারের জন্যে এতটুকু কিছুই না!” পালটা জেদে জবাব দেয় আবরার।
এতোক্ষণে মাকে জড়িয়ে ধরেছে নীতি। কয়েকদিনের গৃহবন্দীত্বে ওর লাভই হয়েছে। বসে বসে শুধু বই পড়েছে, সময় করে হিফ্যের পড়া রিভাইস দিয়েছে আর মজার মজার খেয়েছে।
“চৈতি তুই কিভাবে বুঝলি পাপাই আসল অপরাধী?” অনীমা জানতে চাইলো!
“ পাকা অপরাধী না হলে যা হয়। অনেকগুলো ক্লু দিয়েছে হাতে। প্রথমত, ল্যান্ডফোন লিস্টে কোনো ফোন কল না থাকা, ফোন আসেইনি। হয়তো নীতি আরেক ঘর থেকে রিং করেছে। চাচ্চু এমনিতেও ঠান্ডা মাথার মানুষ তাই নীতি হারানোতে তার কম রিএক্ট করায় সন্দেহ হয়নি। কিন্তু মা-বাবা যেদিন আসবে সেদিন আগেই সে ভালোমতো রান্না করার কথা বলেছে। মা আসবে এটা কেউই জানতো না। বাবা কাউকে জানিয়ে মাকে এনেছে বলে আমার মনে হয় না। তার উপর এটা তো পার্টি মুডের অবস্থা না যে ভালো করে রান্না করতে বলবে! সেদিন অনীমা যখন ছায়া দেখেছিলি ওটা নীতিরই ছিল। আমরা তারা দেখবো আর ও বসে থাকবে এটা নিশ্চয়ই চাচ্চু হতে দিবে না! তোকে হেলুসিনেশন বললেও আমার কাছেও খটকা লাগছিল। পরে দুইয়ে দুইয়ে চার মেলালাম দাড়োয়ান চাচাকে জিজ্ঞেস। চাচ্চু কোনো ঘর সার্চই করেনি!”
“বাহ! বেশ! গোয়েন্দা তুমি যে আমাকে আগেই ফাসাওনি এর জন্যে ধন্যবাদ।“ আবরার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।
“অনেক হয়েছে! সবাই গুছিয়ে নাও। ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হবে। আবরার তুমি আমাদের দুই বাসায় ফোন দাও। মুরব্বিরা টেনশনে আছে।“
ঢাকার উদ্দেশ্যে গাড়ি ছুটছে, দুপুরের রোদটা বেশ কড়া ; গাড়ির কাচে হানা দিচ্ছে। নীতি মায়ের গায়ে হেলান দিয়ে বসে আছে। চৈতি চোখ বন্ধ করে বমি আটকাচ্ছে। অনীমা ক্যামেরার ছবিগুলো দেখছে। আবরার মন দিয়ে ড্রাইভ করছে। ওয়াসিমের জিপ গাড়িটা আলাদাভাবে ঢাকা পৌছানোর ব্যবস্থা হয়েছে। ওয়াসিমের চোখে মুখে প্রশান্তি। আবরারকে স্যরি বলবে না জাযাকাল্লাহু খইরান বলবে বুঝতে পারছে না! গাড়িতে উঠার আগে মাটিতেই শুকরিয়া সিজদাহ দিয়েছে ওয়াসিম। অনীমা বেশ অবাক হয়েছে, খেলার মাঠে ক্রিকেটারদের ছাড়া এভাবে কাউকে সিজ্দাহ দিতেই দেখেনি ও!
(সমাপ্ত)
Main Source & Credit : Click here
0 Comments