একজন মামীর জীবন বৃত্তান্ত ।। জীবন সংসার - Life story of an aunty - Life Leads

আমার ছোট মামির যখন বিয়ে হয় তখন আমার বয়স ছিল ১৩ বছর। ডিগ্রী পাস করে মামী তার ফুপুর বাসায় বেড়াতে এসেছিল। মামির ফুফুরা ছিলেন আমাদের প্রতিবেশী।

আর দশজন ডিগ্রী পাস করা তরুণী-যুবতীদের সাথে মামির কোন মিলই ছিল না। মামি ছিল শান্ত, নরম ধরম টাইপের। ফুপুর মাথায় তেল দিয়ে দিত, চুল আঁচড়ে দিত, রান্না করতো, ঘর গোছাতে, আর বসে বসে সেলাই করতো।

কত যে সেলাই করতো, কত যে সেলাই করতো, তার কোনো হিসাব নাই। সেলাই বলতে কামিজ, ওড়না, বেড কাভার, পিলো কাভার, টি টেবিল ম্যাট ইত্যাদিতে হাতের কাজ।



চারটা ফুফাতো বোন ছিল মামীর। সবাই মামীর ছোট ছিল। তারা আবার সাজুগুজু করতে খুবই পছন্দ করতো। সবাই মিলে মামীর মাথা ঝালাপালা করে দিত। লুসি আপা ,আমাকে এই ডিজাইনটা করে দিবা। লুসি আপা, আমাকে কিন্তু আরও একটা জামা সেলাই করে দিতেই হবে। লুসি আপা, ওর জামার কাজটা আমার থেকে বেশি সুন্দর লাগছে, এরকম করলে হবেনা।

মামি কিন্তু পুরোপুরি শান্ত। বোনদের হইচই দেখে হেসেই কুটিপাটি হয়ে যেত। রাত জেগে জেগে সেলাই করে শখ মেটাতো বোনদের।

আম্মার অনেক পছন্দ হয়েছিল মামিকে। মামির ফুপুর কাছে ছোট মামার জন্য বিয়ের প্রস্তাব দিল। উনারা সব দেখেশুনে রাজি হলেন।

অদ্ভুত এক মানুষ আমার ছোট মামী!
মামাকে কখনো দেখেনি পর্যন্ত। গার্জেনরা বিয়ে ঠিক করলেন, আর মামী তাতেই পূর্ণ সম্মতি দিলো।

মামির আব্বা, মানে নানাভাই ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার। পেশাগত কারণে চট্টগ্রামে থাকতেন তারা। অথচ চট্টগ্রাম শহরে বড় হওয়া মেয়েটা একবারে এসে দর্শনার মতো ছোট্ট একটা এলাকার, ছোট্ট একটা ঘরে সংসার শুরু করলো। বেড়ানোর জায়গা নাই, বিনোদনের জায়গা নাই, এমনকি কাপড় কেনার একটা দোকান পর্যন্ত না। মানসম্মত কাপড় কিনতে হলেও চুয়াডাঙ্গাতে যেতে হতো। কিন্তু তাতেও মামীর কোন আপত্তি নেই।

তখন চুয়াডাঙ্গাতে কোন পার্লার ছিল না। শখ করে আমিই মামীকে সাজিয়েছিলাম বৌভাতের দিন।

অন্য কেউ হলে নির্ঘাত বিরক্ত হতো। বিয়ের দিনে একটু ভালো ভাবে সাজতে কোন মেয়ে না চায়? ১৩ বছরের একটা বাচ্চা, যার কোন ট্রেনিং নাই, সেকি বউ সাজাতে পারে?

কিন্তু মামীর কোনো বিকার নাই। শান্ত মানুষটা প্রচন্ড খুশি ভরে সাজতে বসলো, মনে হল কোন বড় বিউটিশিয়ানের সামনে নিশ্চিন্তে বসে আছে। আমি বিউটিশিয়ান এমনই আনাড়ি , লিপস্টিক দিতে গিয়ে, সেটাও ভেঙে মুখের ভেতর ঢুকে গেল। মামি চকলেট বের করার মতো, থু করে মুখ থেকে বড় এক টুকরা লিপস্টিক বের করল। বিরক্ত হওয়া তো দূরের কথা, এমন হাসি শুরু করলো, আমি আর সাজাতেই পারিনা।

পাশ থেকে অনেকে কমেন্ট করলো, ও ছোটো মানুষ, ও কি পারে নাকি? মামী হাসতে হাসতে উৎসাহ দিল - কোন সমস্যা নাই, তুমি সাজাও তো।

শুধু বৌভাতের সাজ না, জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রেই আমি মামীকে এভাবেই সেক্রিফাইস করতে দেখেছি। মামি ছিল সবার ছোট, কিন্তু আমার নানু মামির সাথেই থাকতেন। ৯১ সাল থেকে আজ পর্যন্ত আমরাও যতবার দর্শনাতে গিয়েছি, ততবার ছোট মামীর ঘরেই উঠেছি।

যৌথ সংসার কিংবা পুরো সংসার জীবনে কত রকমের ঘটনায় মানুষের জীবনে ঘটে। কিন্তু ছোটমামীকে কখনো কোনদিন কোনসময় কারো নামে গীবত করতে শুনিনি। শুধু বলতো, যার যা খুশী করুক, যা খুশি বলুক, আল্লাহ তো সব দেখছেন।

মাস ছয়েক আগে দর্শনাতে গিয়েছিলাম।
আমি, আম্মা, মেজো মামা, মামাতো ভাই, নোয়াখালা, ছোট খালা। আমরা সবাই গল্প করি, কথা বলি, আলোচনা করি। কিন্তু মামী কোন কিছুতেই নেই। সে রান্নাঘরে। নাস্তা দেয়, ভাত দেয়, চা দেয়, রাতের খাবার দেয়, আবার পরের দিনের জন্য খাবার তৈরি করে। একফোঁটা বিরক্তি তো নেই, বরং আরো কিভাবে আতিথেয়তা করবে বুঝে উঠতে পারেনা।

একসময় রান্নাঘরে গিয়ে মামীর হাত ধরে টান দিলাম। ও মামি আসো না, এত রান্না করতে হবে না, একটু রেস্ট নাও না প্লিজ। আমার কথার উত্তর না দিয়ে উল্টা বলল - এ্যই তুমি নাকি গোশত রান্না করতে মানা করেছো? মানা করেছো কেন? মাছও খাবা, গোশতও খাবা। এটা তোমাদের মামার বাড়ি না? এখানে আসলে বেশি বেশি করে খাবা আর বেশি বেশি আবদার করবা। হা হা হা...

আমরা আসার কিছুদিন পর মামি অসুস্থ হলো। চার দিন আগে ঢাকাতে আসলো ডাক্তার দেখাতে। গতকাল সকালে মামীর ভাই লেনিন মামার বাসায় গিয়েছিলাম মামীকে দেখতে। প্রায় তিন ঘন্টা ছিলাম।

মামি ঘুম থেকে উঠলো। সালাম দিলাম। খুব সুন্দর করে একটা হাসি দিল। পাশে এসে একদম গায়ের সাথে ঘেষে ছোট বাচ্চার মত বসলো। এত শুকিয়েছে, দেখে মনে হল ৩৫-৪০ কেজি ওজন। ডাইনিং টেবিলে গিয়ে প্লেটে নাস্তা তুলে দিলাম, আমাদের সবার সাথে নাস্তা খেলো।

তারপর আবার এসে গা ঘেষে বসলো। আমাদের সাথে চা খেলো। চা টা খেয়ে পাশেই শুয়ে পড়ল। তিন কুল পড়ে মামীর গায়ে ফুঁ দিয়ে দিলাম। মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললাম, মামি শোনো, রাসূল (সা:) যখন অনেক অসুস্থ ছিলেন, তখন তিন কুল পড়ে নিজের হাতে ফু দিয়ে নিজের গা টা মুছে নিতেন। তুমিও এটা কোরো, হ্যাঁ মামী? বলল, আচ্ছা।

সুস্থ হয়ে দর্শনা যাওয়ার আগে আমার বাসায় দুই দিনের জন্য আসোনা মামি। বলল, আচ্ছা।

বাসায় আসলাম দুপুর ১২ টায়। রাত দেড়টায় ছোট খালা জানালো মামি আর নাই। মামীকে দেখে বাসায় ফিরলাম এখন। কাফন পরা মামীকে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স রওনা হলো দর্শনার পথে।

আমরা সবাই মামীর শ্বশুরবাড়ির মানুষ।
আশ্চর্য! সবাই শুধু মানুষটার প্রশংসায় করছি। এসব দেখে একটা হাদিস মনে পড়লো-
"রাসুলুল্লাহ (সা:) এর নিকট দিয়ে একটি জানাজা গেল। উত্তম প্রশংসা মুখে মুখে হতে থাকলো; তারা বললো আমাদের জানা মতে সে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে ভালোবাসত।

অতপর রাসুলুল্লাহ (সা:) বললেন,
অপরিহার্য হয়ে গেল।
অপরিহার্য হয়ে গেল।
অপরিহার্য হয়ে গেল।

অতপর রাসুলুল্লাহ (সা:)এর নিকট দিয়ে একটি জানাজা নিয়ে যাওয়া হলো, ঐ জানাজার নিন্দা মুখে মুখে লেগে থাকলো, তারা বললো লোকটি আল্লাহর দ্বীনের ব্যাপারে কতই না খারাপ ছিল!

অতপর রাসুলুল্লাহ (সা:) বললেন,
অপরিহার্য হয়ে গেল।
অপরিহার্য হয়ে গেল।
অপরিহার্য হয়ে গেল।

জানতে চাওয়া হলো,কি অপরিহার্য হয়ে গেল?
উত্তরে বললেন, তোমরা যার উত্তম প্রশংসা করলে তার জন্য জান্নাত অপরিহার্য হয়ে গেল ও তোমরা যার নিন্দা করলে তার জন্য জাহান্নাম অপরিহার্য হয়ে গেল। আর তোমরা পৃথিবীতে আল্লাহর সাক্ষী, তোমরা পৃথিবীতে আল্লাহর সাক্ষী, তোমরা পৃথিবীতে আল্লাহর সাক্ষী।"

আমরা তোমার বান্দা হয়ে সাক্ষী দিচ্ছি মাবুদ, আমাদের জানামতে আমাদের ছোট মামী অনেক ভালো একজন মানুষ ছিলেন। তাঁর সমস্ত গুনাহখাতা মাফ করে দাও মাবুদ। তাঁর সওয়াল জওয়াব সহজ করে দাও দয়াময়। তাঁর কবরকে প্রশস্ত করে দাও। তাঁর কবরকে আলোকিত করে দাও আর তাঁকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করো 🤲

#ফাইজা রুমি আপু।


সংগ্রহঃ Voice of Dawah from Facebook

Reactions

Post a Comment

0 Comments

Close Menu